বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা-কমিশন: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়। তাই ভারত সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্ট
রাধাকৃষ্ণাণ কমিশনের মূল সুপারিশসমূহ:
(১) উচ্চশিক্ষা: স্বাধীনতা লাভের পর উচ্চশিক্ষার গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উন্নতিকল্পে রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, প্রশাসন, শিক্ষক-শিক্ষণ, পরীক্ষা ব্যবস্থা, ছাত্ৰমঙ্গল, নারীশিক্ষা, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা প্রভৃতি বিষয়ে নানান সুপারিশ করে। এছাড়া
(২) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা: রাজ্যে রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে রাজ্য সরকারের উপর। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষা ঠিক পথে না চললে জাতীয় শিক্ষা নির্ণীত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপযুক্ত পরিচালনা সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারকেও দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য থাকবে —
Emphasis (i) উপাচার্য,
(ii) সিনেট বা কোর্ট,
(iii) আচার্য,
(iv) উপচার্য সিন্ডিকেট,
(v) অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল,
(vi) ফ্যাকালটিস,
(vii) বোর্ড অফ স্টাডিজ,
(viii) ফিনান্স কমিটি, এবং
(ix) সিলেকশন কমিটি।
(৩) পরীক্ষা পদ্ধতি: প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির অসারতা সম্বন্ধে রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন বেশ কিছু সুচিন্তিত মন্তব্য করেছে। কমিশনের সদস্যবৃন্দ ঘোষণা করেছিলেন, "If we are to suggest one single reform in university education, it should be that of examinations."
এককথায় প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেছিল কমিশন। পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সম্বন্ধে কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল —
(i) বৈজ্ঞানিক উপায়ে অভীক্ষা প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে হবে।
(ii) প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থায়ী পরীক্ষা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(iii) আভ্যন্তরীণ পরীক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
(iv) বছরে একটা করে পরীক্ষা না দিয়ে কালক্ৰমিক পরীক্ষার প্রবর্তন করতে হবে।
(v) পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রচনাধর্মী ও নতুন অভীক্ষা — এই দুয়েরই সমন্বয়সাধন প্রয়োজন।
(৪) শিক্ষক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নতমান, সাফল্য প্রভৃতি নির্ভর করে যোগ্য, প্রতিভাবান উপযুক্ত শিক্ষকের উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার ও উন্নতির জন্য জ্ঞানীগুণী সুশিক্ষক অবশ্য প্রয়োজন। শিক্ষাদান করাই শিক্ষক নিয়োগের মৌলিক উদ্দেশ্য। একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবলমাত্র পুথিগত বিদ্যা অনুশীলনে ব্যাপৃত না থেকে শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য তাদের চরিত্র গঠনে সহায়তা করবেন। তাই কমিশন সুপারিশ করে —
(i) শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার করে নিয়োগ করতে হবে।
(ii) শিক্ষক ছাড়া কয়েকজন করে গবেষক নিয়োগ করতে হবে।
(iii) যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে শিক্ষকদের পদোন্নতি হবে।
(iv) প্রত্যেক শিক্ষককে ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য যোগ্য শিক্ষকের কর্মদক্ষতা থাকলে তার কার্যকাল ৩ বছর পর্যন্ত বাড়ানো চলবে।
(v) শিক্ষকদের চাকুরির অবস্থা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, কাজ করার সময়, ছুটি সুষ্টভাবে প্রণয়ন করতে হবে।
(৫) গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গঠন: রাধাকৃষ্ণাণ কমিশনের রিপোর্টের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল গ্রামীণ শিক্ষা সম্বন্ধে একটি সর্বাত্মক নতুন চেতনা ঘোষণা করা। ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্ব অনুভব করে শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রামজীবনের সঙ্গে সমন্বয়সাধনের কথা বলেছে কমিশন। কমিশনের মতে, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণীয় বিষয়, পাঠক্রম প্রভৃতি সমস্যাই গ্রামীণ জীবনের পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পিত হবে। প্রকৃতপক্ষে, গ্রামীণ উচ্চশিক্ষার কাঠামোয় থাকবে —
(i) নিম্ন ও উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা — ৭- ৮ বছর ব্যাপী।
(ii) উচ্চ বুনিয়াদী ও মাধ্যমিক শিক্ষা — ৩- ৪ বছর ব্যাপী।
(iii) গ্রামীণ কলেজ — ৩ বছর ব্যাপী। এবং And
(iv) স্নাতকোত্তর শিক্ষা — ২ বছর ব্যাপী।
(৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাঠামো: কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উন্নতির জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতি করার কথাও বলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কাঠামো প্রসঙ্গে যে-সমস্ত সুপারিশগুলি করে তা হল —
(i) বিদ্যালয় ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মোট ১২ বছর শিক্ষাগ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে।
(ii) ১২ বছর বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করার পর শিক্ষার্থীরা কলা ও বিজ্ঞান শাখায় ভরতি হতে পারবে।
(iii) অধিক সংখ্যক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপন করতে হবে।
(iv) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীড় কমাতে কমিশন বৃত্তিশিক্ষার প্রতিষ্ঠান খোলার উপর জোর দিয়েছে।
(v) পাস কোর্সের শিক্ষার্থীরা দু-বছর ও অনার্স কোর্সের শিক্ষার্থীদের তিন বছরের পড়াশোনা করতে হবে।
(vi) পাস কোর্সের শিক্ষার্থীর দু-বছর পরে এবং অনার্সের শিক্ষার্থীরা এক বছর পরে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করবে। অথবা,
(vii) পি এইচ ডি ডিগ্রির শিক্ষাকাল হবে দু-বছরের।
গ্রামীণ শিক্ষার কাঠামোটি হবে —
(i) ৭/৮ বছরের নিম্ন বুনিয়াদি বা প্রাথমিক শিক্ষা,
(ii) ৩/৪ বছরের উত্তর বুনিয়াদি বা মাধ্যমিক শিক্ষা,
(iii) ৩ বছরের গ্রামীণ কলেজীয় শিক্ষা এবং
(iv) ২ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা।
(৭) পাঠক্রম: কমিশন শিক্ষায় উন্নত দেশগুলির পাঠক্রম পর্যালোচনা করে স্বাধীন ভারতের পাঠক্রম কীরূপ হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কলা, বিজ্ঞান, কৃষি, কারিগরি শিক্ষার দিকে লক্ষ রেখে নিম্নলিখিত সুপারিশ করে —
(i) প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে কৃষিবিদ্যা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে।
(ii) সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে কর্মকেন্দ্রিক, পরিবেশকেন্দ্রিক, ব্যাবহারিক, উৎপাদনী ও স্থানীয় জীবনকেন্দ্রিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
(iii) মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক, ব্যাবহারিক ও উন্নত সাহিত্যধর্মী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
(iv) গ্রামীণ বিষয়গুলি ছাড়াও পাঠক্রমে দর্শন, ভাষা, সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, মনোবিদ্যা, অর্থনীতি, কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(v) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক স্বাধিকার বজায় থাকবে।
(৮) পেশাগত শিক্ষা: শিক্ষার্থীর বিকাশ সাধারণধর্মী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। যে-সমস্ত কাজে দক্ষতার প্রয়োজন। সেইসব কাজের জন্য পেশাগত শিক্ষার প্রয়োজন। কমিশন পেশাগত শিক্ষার জন্য যে-সমস্ত বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছে, তা হল —
(i) কৃষি,
(ii) বাণিজ্য,
(iii) শিক্ষাতত্ত্ব,
(iv) ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তিবিদ্যা,
(v) আইন এবং
(vi) চিকিৎসাবিদ্যা।
(৯) শিক্ষার মাধ্যম: বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত একটি ত্রিভাষা নীতির সুপারিশ করেছিল। এই তিনটি ভাষা হল —
(i) মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা,
(ii) ফেডারেল ল্যাঙ্গুয়েজ বা হিন্দি ভাষা এবং
(iii) ইংরেজি ভাষা।
এছাড়া তার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যাশিক্ষার জন্য অবিলম্বে পরিভাষা প্রস্তুতির সুপারিশও কমিশন করেছিল।
(১০) ধর্মশিক্ষা: কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে —
(i) বিদ্যালয়ে দৈনন্দিন কাজ শুরু হওয়ার আগে ছাত্রদের কিছুক্ষণ নীরবে ধ্যান করে চিত্তকে সংযত করে নিতে হবে।
(ii) ডিগ্রি কোর্সের প্রথম বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরুদের জীবনী আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে,
(iii) দ্বিতীয় বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে সর্বজনীন আবেদনপূর্ণ বাণী এবং তৃতীয় বছর ধর্মতত্ত্বের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
(১১) নারীশিক্ষা:
(i) নারীদের শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।
(ii) পুরুষের কলেজে মেয়েদের সুযোগসুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। মেয়েদের ও ছেলেদের শিক্ষাক্রম প্রায় একইরকম হবে।
(iii) নারী হিসেবে ও নাগরিক হিসেবে তাদের কর্তব্যবোধ জাগরিত করে সমাজে যথাযোগ্য স্থান গ্রহণ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
(iv) গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও পরিবার পরিচালনা প্রভৃতি বিষয় তারা যাতে পড়ে সে সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দেওয়া হবে।
(১২) ছাত্ৰমঙ্গল ও শরীরচর্চা:
(i) কমিশন শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক শিক্ষার ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে। এজন্য একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করতে হবে।
(ii) বছরে একবার বিনা ব্যয়ে সকলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iii) শিক্ষার্থীদের জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসাগারের আয়োজন রাখতে হবে।
(iv) দ্বিপ্রহরে অল্প মূল্যে আহার্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রতি কলেজে এন সি সি শরীরচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে।
(১৩) অর্থসংস্থান: কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ব্যয়ভার রাষ্ট্রবহন করবে। নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যসাধনের জন্য অর্থ মঞ্জুর করা হবে —
(i) গৃহনির্মাণকল্পে,
(ii) গ্রন্থাগার উন্নয়নে,
(iii) শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে,
(iv) গবেষণামূলক কাজে প্রভৃতি।
Conclusion রাধাকৃষ্ণাণ কমিশনের প্রতিবেদনটি নবভারত গঠনের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। গ্রামীণ শিক্ষা, ধর্মশিক্ষা, পরীক্ষা পদ্ধতি প্রভৃতি সম্বন্ধে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা বর্তমান সময়ের উপযোগী। বাস্তবে এগুলি গৃহীত হলে ভারতীয় শিক্ষা নবরূপ লাভ করবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন - এর মূল সুপারিশ বা রাধাকৃষ্ণাণ কমিশনের মূল সুপারিশ:
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা-কমিশন: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়। তাই ভারত সরকার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করে। ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের নেতৃত্বে এই কমিশন গঠন করা হয়। তিনি এই কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। তাই তার নাম অনুসারে এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা-কমিশন বা রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন নামে পরিচিত হয়। এটি হল স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন। আসলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কমিশন যে-সমস্ত দিকগুলি পর্যালোচনা করে তা হল — উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, শিক্ষার মাধ্যম, শিক্ষক-শিক্ষিকার মান, গবেষণা, নারীশিক্ষা, ধর্মশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রকল্যাণ, গ্রামীণ শিক্ষা ইত্যাদি।(১) উচ্চশিক্ষা: স্বাধীনতা লাভের পর উচ্চশিক্ষার গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উন্নতিকল্পে রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, প্রশাসন, শিক্ষক-শিক্ষণ, পরীক্ষা ব্যবস্থা, ছাত্ৰমঙ্গল, নারীশিক্ষা, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা প্রভৃতি বিষয়ে নানান সুপারিশ করে। এছাড়া
(২) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা: রাজ্যে রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে রাজ্য সরকারের উপর। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষা ঠিক পথে না চললে জাতীয় শিক্ষা নির্ণীত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপযুক্ত পরিচালনা সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারকেও দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য থাকবে —
Emphasis (i) উপাচার্য,
(ii) সিনেট বা কোর্ট,
(iii) আচার্য,
(iv) উপচার্য সিন্ডিকেট,
(v) অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল,
(vi) ফ্যাকালটিস,
(vii) বোর্ড অফ স্টাডিজ,
(viii) ফিনান্স কমিটি, এবং
(ix) সিলেকশন কমিটি।
(৩) পরীক্ষা পদ্ধতি: প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির অসারতা সম্বন্ধে রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন বেশ কিছু সুচিন্তিত মন্তব্য করেছে। কমিশনের সদস্যবৃন্দ ঘোষণা করেছিলেন, "If we are to suggest one single reform in university education, it should be that of examinations."
এককথায় প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেছিল কমিশন। পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার সম্বন্ধে কমিশনের সুপারিশগুলি ছিল —
(i) বৈজ্ঞানিক উপায়ে অভীক্ষা প্রস্তুতির কাজ শুরু করতে হবে।
(ii) প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থায়ী পরীক্ষা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(iii) আভ্যন্তরীণ পরীক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
(iv) বছরে একটা করে পরীক্ষা না দিয়ে কালক্ৰমিক পরীক্ষার প্রবর্তন করতে হবে।
(v) পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রচনাধর্মী ও নতুন অভীক্ষা — এই দুয়েরই সমন্বয়সাধন প্রয়োজন।
(৪) শিক্ষক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নতমান, সাফল্য প্রভৃতি নির্ভর করে যোগ্য, প্রতিভাবান উপযুক্ত শিক্ষকের উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার ও উন্নতির জন্য জ্ঞানীগুণী সুশিক্ষক অবশ্য প্রয়োজন। শিক্ষাদান করাই শিক্ষক নিয়োগের মৌলিক উদ্দেশ্য। একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবলমাত্র পুথিগত বিদ্যা অনুশীলনে ব্যাপৃত না থেকে শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য তাদের চরিত্র গঠনে সহায়তা করবেন। তাই কমিশন সুপারিশ করে —
(i) শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার করে নিয়োগ করতে হবে।
(ii) শিক্ষক ছাড়া কয়েকজন করে গবেষক নিয়োগ করতে হবে।
(iii) যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে শিক্ষকদের পদোন্নতি হবে।
(iv) প্রত্যেক শিক্ষককে ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য যোগ্য শিক্ষকের কর্মদক্ষতা থাকলে তার কার্যকাল ৩ বছর পর্যন্ত বাড়ানো চলবে।
(v) শিক্ষকদের চাকুরির অবস্থা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, কাজ করার সময়, ছুটি সুষ্টভাবে প্রণয়ন করতে হবে।
(৫) গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গঠন: রাধাকৃষ্ণাণ কমিশনের রিপোর্টের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল গ্রামীণ শিক্ষা সম্বন্ধে একটি সর্বাত্মক নতুন চেতনা ঘোষণা করা। ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্ব অনুভব করে শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রামজীবনের সঙ্গে সমন্বয়সাধনের কথা বলেছে কমিশন। কমিশনের মতে, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণীয় বিষয়, পাঠক্রম প্রভৃতি সমস্যাই গ্রামীণ জীবনের পরিবেশ ও প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পিত হবে। প্রকৃতপক্ষে, গ্রামীণ উচ্চশিক্ষার কাঠামোয় থাকবে —
(i) নিম্ন ও উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা — ৭- ৮ বছর ব্যাপী।
(ii) উচ্চ বুনিয়াদী ও মাধ্যমিক শিক্ষা — ৩- ৪ বছর ব্যাপী।
(iii) গ্রামীণ কলেজ — ৩ বছর ব্যাপী। এবং And
(iv) স্নাতকোত্তর শিক্ষা — ২ বছর ব্যাপী।
(৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাঠামো: কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উন্নতির জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতি করার কথাও বলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কাঠামো প্রসঙ্গে যে-সমস্ত সুপারিশগুলি করে তা হল —
(i) বিদ্যালয় ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মোট ১২ বছর শিক্ষাগ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে।
(ii) ১২ বছর বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করার পর শিক্ষার্থীরা কলা ও বিজ্ঞান শাখায় ভরতি হতে পারবে।
(iii) অধিক সংখ্যক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপন করতে হবে।
(iv) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীড় কমাতে কমিশন বৃত্তিশিক্ষার প্রতিষ্ঠান খোলার উপর জোর দিয়েছে।
(v) পাস কোর্সের শিক্ষার্থীরা দু-বছর ও অনার্স কোর্সের শিক্ষার্থীদের তিন বছরের পড়াশোনা করতে হবে।
(vi) পাস কোর্সের শিক্ষার্থীর দু-বছর পরে এবং অনার্সের শিক্ষার্থীরা এক বছর পরে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করবে। অথবা,
(vii) পি এইচ ডি ডিগ্রির শিক্ষাকাল হবে দু-বছরের।
গ্রামীণ শিক্ষার কাঠামোটি হবে —
(i) ৭/৮ বছরের নিম্ন বুনিয়াদি বা প্রাথমিক শিক্ষা,
(ii) ৩/৪ বছরের উত্তর বুনিয়াদি বা মাধ্যমিক শিক্ষা,
(iii) ৩ বছরের গ্রামীণ কলেজীয় শিক্ষা এবং
(iv) ২ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা।
(৭) পাঠক্রম: কমিশন শিক্ষায় উন্নত দেশগুলির পাঠক্রম পর্যালোচনা করে স্বাধীন ভারতের পাঠক্রম কীরূপ হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কলা, বিজ্ঞান, কৃষি, কারিগরি শিক্ষার দিকে লক্ষ রেখে নিম্নলিখিত সুপারিশ করে —
(i) প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে কৃষিবিদ্যা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে।
(ii) সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে কর্মকেন্দ্রিক, পরিবেশকেন্দ্রিক, ব্যাবহারিক, উৎপাদনী ও স্থানীয় জীবনকেন্দ্রিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
(iii) মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক, ব্যাবহারিক ও উন্নত সাহিত্যধর্মী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
(iv) গ্রামীণ বিষয়গুলি ছাড়াও পাঠক্রমে দর্শন, ভাষা, সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, মনোবিদ্যা, অর্থনীতি, কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(v) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক স্বাধিকার বজায় থাকবে।
(৮) পেশাগত শিক্ষা: শিক্ষার্থীর বিকাশ সাধারণধর্মী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। যে-সমস্ত কাজে দক্ষতার প্রয়োজন। সেইসব কাজের জন্য পেশাগত শিক্ষার প্রয়োজন। কমিশন পেশাগত শিক্ষার জন্য যে-সমস্ত বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছে, তা হল —
(i) কৃষি,
(ii) বাণিজ্য,
(iii) শিক্ষাতত্ত্ব,
(iv) ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তিবিদ্যা,
(v) আইন এবং
(vi) চিকিৎসাবিদ্যা।
(৯) শিক্ষার মাধ্যম: বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত একটি ত্রিভাষা নীতির সুপারিশ করেছিল। এই তিনটি ভাষা হল —
(i) মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা,
(ii) ফেডারেল ল্যাঙ্গুয়েজ বা হিন্দি ভাষা এবং
(iii) ইংরেজি ভাষা।
এছাড়া তার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যাশিক্ষার জন্য অবিলম্বে পরিভাষা প্রস্তুতির সুপারিশও কমিশন করেছিল।
(১০) ধর্মশিক্ষা: কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে —
(i) বিদ্যালয়ে দৈনন্দিন কাজ শুরু হওয়ার আগে ছাত্রদের কিছুক্ষণ নীরবে ধ্যান করে চিত্তকে সংযত করে নিতে হবে।
(ii) ডিগ্রি কোর্সের প্রথম বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরুদের জীবনী আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে,
(iii) দ্বিতীয় বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে সর্বজনীন আবেদনপূর্ণ বাণী এবং তৃতীয় বছর ধর্মতত্ত্বের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
(১১) নারীশিক্ষা:
(i) নারীদের শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।
(ii) পুরুষের কলেজে মেয়েদের সুযোগসুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। মেয়েদের ও ছেলেদের শিক্ষাক্রম প্রায় একইরকম হবে।
(iii) নারী হিসেবে ও নাগরিক হিসেবে তাদের কর্তব্যবোধ জাগরিত করে সমাজে যথাযোগ্য স্থান গ্রহণ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
(iv) গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও পরিবার পরিচালনা প্রভৃতি বিষয় তারা যাতে পড়ে সে সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দেওয়া হবে।
(১২) ছাত্ৰমঙ্গল ও শরীরচর্চা:
(i) কমিশন শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক শিক্ষার ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে। এজন্য একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করতে হবে।
(ii) বছরে একবার বিনা ব্যয়ে সকলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
(iii) শিক্ষার্থীদের জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসাগারের আয়োজন রাখতে হবে।
(iv) দ্বিপ্রহরে অল্প মূল্যে আহার্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রতি কলেজে এন সি সি শরীরচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে।
(১৩) অর্থসংস্থান: কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ব্যয়ভার রাষ্ট্রবহন করবে। নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যসাধনের জন্য অর্থ মঞ্জুর করা হবে —
(i) গৃহনির্মাণকল্পে,
(ii) গ্রন্থাগার উন্নয়নে,
(iii) শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে,
(iv) গবেষণামূলক কাজে প্রভৃতি।
Conclusion রাধাকৃষ্ণাণ কমিশনের প্রতিবেদনটি নবভারত গঠনের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। গ্রামীণ শিক্ষা, ধর্মশিক্ষা, পরীক্ষা পদ্ধতি প্রভৃতি সম্বন্ধে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা বর্তমান সময়ের উপযোগী। বাস্তবে এগুলি গৃহীত হলে ভারতীয় শিক্ষা নবরূপ লাভ করবে।
COMMENTS